Huawei Mate XTs ট্রাই ফোল্ড স্মার্টফোন: বিপ্লবী প্রযুক্তির নতুন যুগ
প্রযুক্তির জগতে একটি নতুন বিপ্লব এসেছে। Huawei Mate XTs ট্রাই ফোল্ড স্মার্টফোন লঞ্চ হয়েছে যা সত্যিকারের অর্থেই একটি অনন্য ডিভাইস। এই ফোনটি শুধু একটি স্মার্টফোন নয়, বরং একটি ভবিষ্যতের গ্যাজেট যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
চীনের বিখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সালে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ট্রিপল ফোল্ডেবল স্মার্টফোন উন্মোচন করেছে। এটি বিশ্বের একমাত্র কোম্পানি যারা দুইবার ট্রাই ফোল্ড প্রযুক্তি বাজারে এনেছে, যেখানে অন্য কোম্পানিগুলো এখনও তাদের প্রথম ট্রাই ফোল্ড ফোন বানাতে পারেনি।
কী বিশেষত্ব রয়েছে Huawei Mate XTs এ?
Huawei Mate XTs এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এর ট্রিপল ফোল্ডিং সিস্টেম। সাধারণ ফোল্ডেবল ফোনে একটি কব্জা থাকে, কিন্তু এই ফোনে রয়েছে দুইটি কব্জা যা একে তিনটি ভিন্ন আকারে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়।
প্রথমে এটি একটি সাধারণ ৬.৪ ইঞ্চি স্মার্টফোন হিসেবে কাজ করে। তারপর এক ভাঁজ খুলে দিলে এটি ৭.৯ ইঞ্চি ট্যাবলেট হয়ে যায়। আর সম্পূর্ণ খুলে দিলে পাওয়া যায় ১০.২ ইঞ্চি বড় স্ক্রিন যা একটি ছোট ল্যাপটপের মতো কাজ করতে পারে।
এই বিপ্লবী ডিজাইন ব্যবহারকারীদের একই ডিভাইসে তিনটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়। সকালে খবর পড়ার জন্য ছোট স্ক্রিন, দুপুরে বই পড়ার জন্য মাঝারি স্ক্রিন, আর সন্ধ্যায় মুভি দেখার জন্য বড় স্ক্রিন ব্যবহার করা যায়।
শক্তিশালী পারফরম্যান্স ও র্যাম
Huawei Mate XTs এ ব্যবহার করা হয়েছে হুয়াওয়ের নিজস্ব কিরিন ৯০২০ চিপসেট। এই চিপসেট আগের প্রজন্মের তুলনায় ২০ থেকে ৩৬ শতাংশ বেশি দ্রুত কাজ করতে পারে। এর সাথে রয়েছে ১৬ জিবি র্যাম যা যেকোনো ধরনের কাজ মসৃণভাবে চালানোর জন্য যথেষ্ট।
এত বেশি র্যাম থাকার কারণে একসাথে অনেকগুলো অ্যাপ চালানো যায়। যেমন একই সময়ে ভিডিও দেখা, গেমস খেলা, এবং কাজের অ্যাপ ব্যবহার করা সম্ভব। এটি সত্যিকারের মাল্টিটাস্কিং এর স্বর্গ।
অসাধারণ ক্যামেরা সিস্টেম
ফটোগ্রাফির জন্য Huawei Mate XTs এ রয়েছে একটি চতুর্মুখী ক্যামেরা সিস্টেম। মূল ক্যামেরা হলো ৫০ মেগাপিক্সেল যাতে রয়েছে ভেরিয়েবল অ্যাপারচার এবং অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন। এর পাশাপাশি আছে ৪০ মেগাপিক্সেল আল্ট্রাওয়াইড ক্যামেরা এবং ১২ মেগাপিক্সেল পেরিস্কোপ টেলিফটো ক্যামেরা যা ৫.৫ গুণ অপটিক্যাল জুম সাপোর্ট করে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো RYYB পিক্সেল লেআউট যা কম আলোতেও দুর্দান্ত ছবি তুলতে পারে। এছাড়াও রয়েছে একটি ১.৫ মেগাপিক্সেল মাল্টি-স্পেক্ট্রাল ক্যামেরা যা রঙের গুণমান উন্নত করে। সেলফির জন্য আছে ৮ মেগাপিক্সেল আল্ট্রাওয়াইড ক্যামেরা।
দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি ও দ্রুত চার্জিং
এত বড় স্ক্রিন এবং শক্তিশালী হার্ডওয়ারের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ব্যাটারি। Huawei Mate XTs এ রয়েছে ৫,৬০০ এমএএইচ ব্যাটারি যা সারাদিন ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট।
চার্জিংয়ের ক্ষেত্রেও এগিয়ে এই ফোন। রয়েছে ৬৬ ওয়াট ফাস্ট চার্জিং, ৫০ ওয়াট ওয়্যারলেস চার্জিং, এবং ৭.৫ ওয়াট রিভার্স ওয়্যারলেস চার্জিং। এর মানে হলো অন্য ডিভাইসও এই ফোন দিয়ে চার্জ করা যাবে।
স্টাইলাস সাপোর্ট ও প্রোডাক্টিভিটি
নতুন Huawei Mate XTs এ যোগ হয়েছে M-Pen 3 স্টাইলাস সাপোর্ট। বড় স্ক্রিনে লেখালেখি, আঁকাআঁকি, এবং নোট নেওয়ার জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী। স্টাইলাস দিয়ে এয়ার-মাউস মোড ব্যবহার করে ভিডিও নিয়ন্ত্রণ এবং প্রেজেন্টেশনে পেজ পরিবর্তন করা যায়।
হারমনিওএস ৫.১ অপারেটিং সিস্টেমে পিসি-গ্রেড অ্যাপ চালানো যায় যা অফিসের কাজকর্মকে আরও সহজ করে তোলে। একসাথে অনেকগুলো উইন্ডো খোলা, সাইজ পরিবর্তন এবং স্থান পরিবর্তন করা যায় ঠিক কম্পিউটারের মতো।
হারমনিওএস ৫.১ ও এআই ফিচার
Huawei Mate XTs চলে হারমনিওএস ৫.১ এ যাতে রয়েছে উন্নত সেলিয়া এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই এআই সহায়ক ভ্রমণ পরিকল্পনা তৈরি, অনুবাদ, নথি সম্পাদনা, এবং শিক্ষামূলক পডকাস্ট তৈরি করতে পারে।
সেলিয়া এআই এর বিশেষ ক্ষমতাগুলো হলো:
- ভ্রমণ পরিকল্পনা: হোটেল, দর্শনীয় স্থান সব কিছুর পরিকল্পনা
- ধারাবাহিক অনুবাদ: একাধিক স্ক্রিনে একসাথে অনুবাদ
- জ্ঞান সংরক্ষণ: শেখা বিষয়গুলো সংরক্ষণ ও পডকাস্ট তৈরি
- মোবাইল অফিস: স্মার্টফোনে কম্পিউটারের মতো কাজ
উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা
Huawei Mate XTs এ ব্যবহৃত হয়েছে আল্ট্রা টাফ গ্লাস (UTG) যা বহুমুখী ভাঁজের বিপরীতে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করে। তিয়ানগং ডুয়েল-হিঞ্জ সিস্টেম নিশ্চিত করে যে ফোন খোলা ও বন্ধ করা সর্বদা মসৃণ থাকে।
কানেক্টিভিটির জন্য রয়েছে ওয়াই-ফাই ৬, ব্লুটুথ ৫.২, এনএফসি, এবং স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন। এর মানে হলো সেলুলার নেটওয়ার্ক দুর্বল হলেও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মেসেজ পাঠানো যাবে। নিরাপত্তার জন্য আছে সাইড-মাউন্টেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর।
রঙ ও ডিজাইন
Huawei Mate XTs আসছে চারটি আকর্ষণীয় রঙে: ব্ল্যাক, রেড, হোয়াইট, এবং পার্পেল। নতুন হোয়াইট এবং পার্পেল রঙের সাথে রয়েছে লেদার ফিনিশ যা ফোনটিকে আরও প্রিমিয়াম লুক দেয়। ফোনের ওজন ২৯৮ গ্রাম যা এর আকার বিবেচনায় যুক্তিসঙ্গত।
দাম ও উপলব্ধতা
Huawei Mate XTs এর দাম শুরু হয়েছে ১৭,৯৯৯ চীনা ইউয়ান (প্রায় ২,২২,৩০০ টাকা) থেকে ১৬ জিবি র্যাম + ২৫৬ জিবি স্টোরেজ মডেলের জন্য। অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের দাম:
- ১৬ জিবি র্যাম + ৫১২ জিবি স্টোরেজ: ১৯,৯৯৯ ইউয়ান (প্রায় ২,৪৭,১০০ টাকা)
- ১৬ জিবি র্যাম + ১ টিবি স্টোরেজ: ২১,৯৯৯ ইউয়ান (প্রায় ২,৭১,৯০০ টাকা)
- স্টাইলাস সেট: ২২,৪৯৯ ইউয়ান
চীনে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রি-অর্ডার শুরু হয়েছে এবং ১২ সেপ্টেম্বর থেকে বিক্রি শুরু হবে। হুয়াওয়ে ৫০% পর্যন্ত স্ক্রিন রিপ্লেসমেন্ট ছাড় এবং বিনামূল্যে হোম সার্ভিস দিচ্ছে।
বাজারে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
Huawei Mate XTs শুধু একটি ফোন নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রযুক্তির স্বাদ। চীনের ফোল্ডেবল ফোনের বাজারে হুয়াওয়ের ৭৫% শেয়ার রয়েছে এবং আগের Mate XT মডেল থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়েছে।
এই সাফল্য প্রমাণ করে যে ইনোভেটিভ প্রযুক্তির চাহিদা রয়েছে, এমনকি উচ্চ দামেও। Samsung এর মতো কোম্পানিগুলো এখনও তাদের প্রথম ট্রাই ফোল্ড ফোন তৈরি করতে পারেনি, যেখানে হুয়াওয়ে ইতিমধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মে পৌঁছে গেছে।
উপসংহার
Huawei Mate XTs ট্রাই ফোল্ড স্মার্টফোন প্রযুক্তির জগতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১৬ জিবি র্যাম, ৫০ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা, এবং ট্রিপল ফোল্ডিং ডিজাইন এর সমন্বয়ে এটি একটি অনন্য ডিভাইস।
যদিও দাম বেশি, তবুও যারা সর্বোচ্চ প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতা চান, তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ পছন্দ। হুয়াওয়ের এই বিপ্লবী উদ্ভাবন প্রমাণ করে যে প্রযুক্তির জগতে এখনও অনেক কিছু সম্ভব।
এই ফোনটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং কাজ, বিনোদন, এবং সৃজনশীলতার একটি সম্পূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। ভবিষ্যতে আরও কোম্পানি এই ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে আসবে, কিন্তু হুয়াওয়ে ইতিমধ্যেই সেই ভবিষ্যৎ তৈরি করে ফেলেছে।